সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলমান কবি দৌলত কাজি । দৌলত কাজি আরাকান রাজসভার সংবর্ধিত ও শ্রেষ্ঠ কবি। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের দৈবী পরিমণ্ডলের মধ্যে
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দৌলত কাজির 'লোরচন্দ্রাণী' স্মরণীয় কেন অথবা সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলমান কবি দৌলত কাজি
দৌলত কাজি
সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলমান কবি দৌলত কাজি । দৌলত কাজি আরাকান রাজসভার সংবর্ধিত ও শ্রেষ্ঠ কবি। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের দৈবী পরিমণ্ডলের মধ্যে তাঁর 'সতী ময়নামতী' বা 'লোরচন্দ্রাণী' কাব্যটি লক্ষণীয় স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। কবি সুফীমতাবলম্বী ছিলেন এবং চট্টগ্রামের অন্তর্গত সুলতানপুরে ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে তাঁর জন্ম।
দৌলত কাজি ষোড়শ শতাব্দীর শেষ ভাগে কবি জন্মগ্রহণ করেন।চট্টগ্রামের অন্তর্গত সুলতানপুরের অধিবাসী ছিলেন দৌলত কাজি।আরাকান রাজসভার দুজন উল্লেখযোগ্য কবির নাম দৌলত কাজি ও সৈয়দ আলাওল। দৌলত কাজি আরাকান রাজ শ্রীসুধর্মার রাজসভায় উপস্থিত ছিলেন ও সমাদর লাভ করেন।সপ্তদশ শতকে আরাকান আনুকূল্যে মুসলমান কবিরা যে কাব্যসাহিত্য রচনা করেছিলেন তা মানবীয় রসমণ্ডিত। এই নতুন ধারা বাংলা সাহিত্যে রোমান্টিক প্রণয়কাহিনি যুক্ত করল। এই শ্রেণির কাব্য প্রধানত ফারসি ও হিন্দি থেকে অনূদিত। সৈয়দ আলাওল ও দৌলত কাজি—এই ধারার দুজন প্রধান কবি।
সতী ময়নামতী' বা 'লোরচন্দ্রাণী' তার রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে অন্যতম । ১৬২১ থেকে ১৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে দৌলত কাজি তাঁর কাব্যটি রচনা গুলি করেন বলে জানা যায় । আরাকান রাজ্যের সমরসচিব আশরফ খানের পৃষ্ঠপোষকতায় ও নির্দেশে 'লোরচন্দ্রাণী' কাব্যটি রচিত।রোমান্টিক কাব্য- 'সতী ময়নামতী' বা 'লোরচন্দ্রাণী' কাব্যটি।'লোরচন্দ্রাণী' কাব্যের প্রধান চরিত্র কোনগুলি ছিল লোরক-ময়না, চন্দ্রাণী-বামন।
তবে লোরচন্দ্রাণী' কাব্যটির পুর অংশ টা দৌলত কাজি রচনা করেন নি কাব্যটির দুই-তৃতীয়াংশ রচনা করেন, কারণ পরে কবি মারা যান। পরবর্তি সময়ে আরাকান রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী সুলেমানের নির্দেশে অসম্পূর্ণ লোরচন্দ্রাণী' কে সমাপ্ত করেন আরাকান রাজসভার অপর বিশিষ্ট কবি সৈয়দ আলাওল কাব্যটির লেখা সম্পূর্ণ করেন।
দৌলত কাজি মিয়াঁ সাধন নামক হিন্দি কবি রচিত "ময়নাকো সৎ' নামক কাহিনি কাব্যের অনুসরণে তাঁর কাব্য রচনা করেন।দৌলত কাজির কাব্য অনুবাদ কর্ম, তবে তা আক্ষরিক নয়। এর মধ্যে কবির স্বকীয়তা বহুলাংশে লক্ষিত। 'লোরচন্দ্রাণী' কাব্যটিতে পয়ার ত্রিপদী ছন্দ ব্যবহার করা হয়েছে ।
দৌলত কাজির কাব্যের বৈশিষ্ট্য কী কী ?
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের দৈবী পরিমণ্ডলের মধ্যে দৌলত কাজির কাব্যটি ব্যতিক্রমে উজ্জ্বল। এই কাব্যে বাস্তব নরনারীর যে প্রণয়কথা ও সুখদুঃখের চিত্র চিত্রিত তাতে বাংলা কাব্যের গতানুগতিকতার মধ্যে নতুন জীবনচেতনার আদর্শ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
দৌলত কাজির কবিপ্রতিভার বৈশিষ্ট্যগুলি
দৌলত কাজির রচনা সৃষ্টিশীলতায় প্রাণোজ্জ্বল। অপরের কাহিনি অনুসরণ করলেও সেখানে তাঁর মনের মাধুরী প্রদীপ্ত। আলাওল ইসলামীয় ভগবৎ মাহাত্ম্য প্রথমে কাব্যে তুলে ধরেছেন আর চরিত্রসৃষ্টিতে দৌলত কাজি বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছেন।
'লোরচন্দ্রাণী' কাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র কেন ?
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের দৈব নির্ভরতার বেড়া ডিঙিয়ে লোরচন্দ্রাণী' স্বাতন্ত্রে উজ্জ্বল। অনুভূ তির গভীরতায়, মানব চরিত্রের সার্থক রূপায়ণে প্রেমের মুক্তমহিমা প্রচারে ও সরস রচনারীতিতে দৌলত কাজির কাব্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দৌলত কাজির 'লোরচন্দ্রাণী' স্মরণীয় কেন ?
দৌলত কাজির 'লোরচন্দ্রাণী' মধ্যযুগের দেববাদপুষ্ট বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিকতা ভঙ্গ করে নতুন জীবনাদর্শের জয়ধ্বনি ঘোষণা করেছে। মানব-মানবীর প্রেমলীলাকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করার কাজে তিনি অন্যতম পথিকৃৎ। দুঃখের বিষয় তিনি কাব্যটি শেষ করে যেতে পারেননি। ফলে তাঁর মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রেমসংগীতের অখন্ড তাৎপর্য ধরা পড়েনি। তবুও অসমাপ্ত রচনার মধ্যে তিনি নবজীবনের ব্যঞ্জনা দিয়ে গেছেন। এ কারণে দৌলত কাজি ও তাঁর কাব্য স্মরণীয়।
‘সতী ময়নামতী' বা 'লোরচন্দ্রাণী' কাব্যের কাহিনির উৎস সম্পর্কে কী জানা যায় ?
মিয়া সাধনের রচনা ছাড়াও লোরচন্দ্রাণী'র কাহিনি সপ্তদশ শতাব্দীতে উত্তর-পশ্চিম প্রদেশে অজ্ঞাত ছিল না। ডক্টর সুকুমার সেন অনুমান করেন, ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে বাংলাদেশে যে 'কোয়ালি’ বা 'গোহাল্যা-র গীত গাওয়া হত লোরচন্দ্রাণীর কাহিনির উৎস সেই গীত ।
সপ্তদশ শতাব্দীর মুসলমান কবি দৌলত কাজি ও সৈয়দ আলাওলের গুরুত্ব নির্ণয়
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিষয়বস্তুর অভিনবত্বের জন্য আরাকানের মুসলিম কবিদ্বয় দৌলত কাজি ও সৈয়দ আলাওলের রচনা ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ। মানব-মানবীর রোমান্টিক প্রণয়কাহিনি রচনা করে ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদের মহিমা ঘোষণা করে সৃষ্টির নতুনত্বে বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিকতা ভঙ্গ করলেন। এই দুজন কবি বাংলা সাহিত্যে আধুনিকতার পূর্ব সূচনা করে গেছেন।
সপ্তদশ শতাব্দীর দুই স্বনামখ্যাত কবি দৌলত কাজি ও সৈয়দ আলাওল রোসাঙ রাজসভার সভাকবি ছিলেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মানব রসমণ্ডিত রোমান্টিক কাহিনিকাব্য এবং হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার জন্য রোসাও রাজসভা প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে।
COMMENTS